পদ্ম গাছ নিয়ে মানুষের কিছু ভুল ধারণা – পঞ্চম পর্ব।

আজকের পর্বটা আসলে অন্যরকম । গত এক সপ্তাহ ধরে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ব্রডকাস্ট চ্যানেলে যে পদ্ম নিয়ে টিউটোরিয়াল চলছে সেটার সারসংক্ষেপ। পড়ুন , অনেক কিছু জানতে পারবেন।
আপনারা চাইলে ওই হোয়াটসঅ্যাপ ব্রডকাস্ট চ্যানেলে জইন করতে পারেন , ফ্রি টিউটোরিয়াল , কোনো এন্ট্রি ফি নেই !
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ১ ) – পদ্ম গাছ খোলা জায়গায় হয় ঠিকই , তবে ছোটো জায়গায় সারাদিন রোদ পেলে গামলা গরম হয়ে গাছের ক্ষতি করে। অত্যধিক গরমে একটা অস্থায়ী সেড করে দিলে গাছ ভালো থাকবে। খুব গরম না থাকলে সারাদিন রোদে থাকলেও কোনো সমস্যা করে না। নতুন গাছ বসালে অবশ্যই সেড দিন , এমন জায়গায় রাখুন যেখানে উজ্জ্বল আলো পাবে কিন্তু দুপুরের চরা রোদটা সারাদিন পাবে না।
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ২ ) – প্লাস্টিক এর গামলায় যাঁরা পদ্ম গাছ করেন দুপুর দুটোর সময় একবার গামলার জলে হাত দিয়ে দেখবেন , হাতে ছ্যাকা লাগবে এখন। একটা চটের বস্তার গায়ে কাদামাটির হালকা স্তর লাগিয়ে গামলার গায়ে জড়িয়ে দিলে দেখবেন গাছ অনেক ভালো আছে। সারাবছর এটা লাগে না ,তবে এই অত্যধিক গরমের দিনে সেড দেওয়ার জায়গা না থাকলে এটা করে দেখতে পারেন । বেশ কাজে দেয়।
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ৩ ) – অনেক জায়গায় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। গাছকে ভিজতে দিন । কুঁড়ি কিছু নষ্ট হবে , হোক… । গাছ ভালো থাকলে আবার কুঁড়ি আসবে ।
একটা দুটো কুঁড়ির মায়া করে গাছকে এই বৃষ্টির জলটা থেকে বঞ্চিত করলে খুবই খারাপ কাজ করবেন। বৃষ্টির জল ,জলের গাছের জন্য গ্রোথ স্টিমুলেটর। দুদিনে গাছের ভোল বদলে যাবে। দুটো কুঁড়ি বৃষ্টির জলে নষ্ট হলে , কুড়িটা কুড়ি আবার চলে আসবে।
শিল পড়লে কিন্তু মুস্কিল! পাতা ফেটে ফুটে একাকার হয়ে যাবে। গাছ স্ট্রেস নিয়ে ডরমান্সি তে চলে গেলে আর ফুল দেবে না। শিল পড়া গাছকে আবার দাড় করানো একটু এক্সপেরিয়েন্স এর ব্যাপার, গাছের কন্ডিশন দেখে ডিসিশন নিতে হয় সব পাতা কেটে ফেলবেন নাকি রেখে দেবেন।
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ৪ ) – ছোটো ছোটো লার্ভা । জলের গাছে, বিশেষ করে পদ্ম গাছে এটা হয় । সবসময় হয় না , কিছু স্পেসিফিক সময় আছে এর। এখন মনে এই এপ্রিল , মে মাসে এটা একবার হয়।
এমনিতে পদ্ম গাছে পোকা খুব কমই লাগে। তবে বছরে দুবার এটা আসে। ঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিয়ে নিলে খুব কম পরিশ্রমে আপনার কাজ মিটে যাবে, নাহলে গাছের পাতা খেয়ে শেষ করে দেবে। পাতা খেয়ে নিলে গাছ স্ট্রেস নিয়ে ফুল দেওয়া বন্ধ করে দেবে ।
এগুলো হচ্ছে ক্লাস্টার ক্যাটারপিলার মথ এর লার্ভা। চেনাটা জরুরী, না চিনলে ব্যবস্থা নেবেন কিভাবে?
দেখতে পেলে কি করবেন?
১. দেখা মাত্র পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। দূরে ফেলবেন । এরা উড়তে পারে না , পায়ে হেঁটে খুব বেশি দূরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা এদের নেই। তাই দূরে ফেলে এলে আর আসতে পারবে না।
২. খুব বেশি হয়ে গেলে KAKA এক লিটার জলে পনেরো ফোঁটা গুলে সেই জলটা স্প্রে করুন। বা একটা তামাক পাতা সারারাত এক লিটার জলে ভিজিয়ে রেখে সেই জলটা পরের দিন সকালে ছেঁকে নিয়ে গাছের পাতাতে স্প্রে করবেন।
গামলায় মাছ থাকলে তুলে রেখে এসব করবেন। গাছ ঘেঁষাঘেঁষি করে রাখলে একটা গাছ থেকে অন্য গাছে এরা যাবে ।
একদম প্রথম স্টেজে এটা করতে পারলে একবারেই কাজে দেবে নাহলে আপনার জলবাগান ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই ক্লাস্টার ক্যাটারপিলার মথ এর লার্ভা।
এগুলো দেখতে পেলে প্যানিক না ,বিদ্যা কাজে লাগান। প্রথম স্টেজে গাছের সমস্যা ধরার জন্য গাছের কাছে অন্তত রোজ একবার করে যাওয়াটা দরকার, শুধু গেলেই হবে না প্রতিটা পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাটাও জরুরী !
সবথেকে ভালো উপায় রাতে ঘুমানোর আগে ভূতের মতো আপনার বাগানে ঘুরে বেড়ান, হাতে একটা টর্চ নিয়ে। অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোতে গাছের সমস্যা অনেক সহজে ধরতে পারবেন । এক্সট্রা বেনিফিট শোবার আগে একটু গাছের কাছে থাকলে মন শান্ত হয়ে আসে, ঘুম ভালো হয়।
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ৫ ) – তিন ফুট ব্যাস , পনেরো ইঞ্চি গভীরতার তিনশো মাইক্রন এর প্লাস্টিক পুল। এরকম জায়গায় গাছ করলে তিন চার বছর গাছ রিপট না করলেও কোনো সমস্যা নেই। এই গাছটা রিপট করিনি এবারে, হাত ঢুকিয়ে দেখে নিয়েছি অনেক জায়গা খালি আছে। সুন্দর গ্রোথ নিয়েছে ,প্রায় ২০ টা মতো কুঁড়ি এসে গেছে।
সবথেকে বড় অ্যাডভান্টেজ পনেরো দিনে একবার জল দিলেই যথেষ্ট, বড়ো জায়গায় জল কমে অনেক দেরিতে। মাটি আর কম্পোস্ট ১০:১ এই রেশিও তে মিক্স করে মিডিয়া বানানো । খাবার বলতে অর্গানিক মিক্স ফার্টিলাইজার পনেরো দিন অন্তর একবার করে । মোদ্দা কথা , যাঁরা ব্যস্ত মানুষ রোজ রোজ গাছের পিছনে সময় দেওয়ার মতো সময় নেই, এরকম জায়গায় গাছ করুন … পনেরো দিন পাঁচটা মিনিট সময় দিলেই যথেষ্ট…
কারো বাজেটের সমস্যা না থাকলে এরকম একটা জায়গায় গাছ করতে পারেন । অসম্ভব ভালো রেজাল্ট,বিনা পরিশ্রমে। তবে নীল রঙের না কিনে কালো রঙের কিনলে অনেক বেশি ভালো দেখতে লাগে , প্লাস জলের গাছ যেহেতু রুটে আলো পছন্দ করে না , তাই কালো জায়গায় বেশি ভালো গাছ হয়।
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ৬ ) – মাটির জায়গায় সবথেকে ভালো পদ্ম গাছ হয়। বারো ইঞ্চি প্যারালাল টবে প্রায় সব ভ্যারাইটি ফুল দেয়। মাটির টব কিনে এনে হোয়াইট সিমেন্ট দিয়ে ফুটো গুলো বুজিয়ে তাতে পদ্ম গাছ করতে পারেন।
তবে মাটির টবে জল তাড়াতাড়ি কমে , আপনাকে দু তিনদিন অন্তর একবার করে জল দিতে হবে। মাটির টবের গায়ে নিজের ইচ্ছা মতো পেন্ট করে নিলে জল অনেকদিন থাকবে আর দেখতেও দুর্দান্ত লাগবে।
মাটির টবের গাছে ফুলের সাইজ, রং এর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়। গরমকালে মাটির টব গরম কম হয় বলে গাছ হিট ডরমেন্সি তে যায় না।
তবে ভারী বেশি হয়,প্লাস্টিক এর গামলার মতো উল্টে দিয়ে রিপট করা যায় না।
সুবিধা , অসুবিধা দুটোই বললাম , এবার আপনাদের চয়েস!
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ৭ ) – যেকোনো গাছের পাতা সময়ের সাথে নষ্ট হয়ে যায়। পদ্ম গাছেরও পাতা বয়স হলে নষ্ট হয়ে যায় আর জলের সাথে পাতা লেগে থাকলে পচেও যায়। এটা নর্মাল , এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই । ওপরের ছবিতে যে পাতাগুলো নষ্ট হয়েছে ওগুলো ন্যাচারাল এজিং।
দেখতে ভালো না লাগলে কেটে ফেলে দিতে পারেন , তবে গামলায় থাকলেও কোনো সমস্যা নেই , বরং ভালো। পচে হিউমাস সৃষ্টি করবে, যেটা গাছের গ্রোথ এর জন্য ভালো।
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় । সার বেশি হয়ে গেলে বা রোদে পুড়েও অনেক সময় পাতা নষ্ট হয় । শামুক কে অনেক সময় পাতা নষ্ট করে দেয়, মথ এর লার্ভা তেও পাতা নষ্ট করে।
এখন কোনটা ন্যাচারাল এজিং আর কোনটা ন্যাচারাল না এটা ধরতে পারাটা জরুরী। কিছু টিপস্ দিচ্ছি খানিকটা বুঝতে পারবেন। যাঁরা আমার থেকে গাছ নিয়েছেন আমাকে ছবি পাঠালে আমি বলে দেবো কি হয়েছে।
১. পাতাতে যদি সাদা সাদা স্পট দেখতে পান আর খুব ছোটো ছোটো ল্যাদা পোকার মতো পোকা দেখতে পান ওটা মথ অ্যাটাক। দেখা মাত্র পাতাটা কেটে দূরে ফেলে দিন। খুব বেশি হয়ে গেলে KAKA 2ML/LITRE জলে গুলে তিনদিন অন্তর তিনবার স্প্রে করতে পারেন। বা একটা তামাক পাতা সারারাত জলে ভিজিয়ে পরের দিন সকালে জলটা ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করলেও খুব ভালো কাজ দেয়।
২. পাতা ধারের দিক থেকে গোল করে কেন্দ্রের দিকে শুকনো হয়ে খারাপ হতে শুরু করলে বা জায়গায় জায়গায় রং ফ্যাকাশে হয়ে গেলে সেটা হয় সার বেশি হয়ে গেছে বা খুব রোদ লেগে গেছে।
৩. পাতা কুঁকড়ে গেলে, পুরোটা না খুললে ওটা রুটে নেমাটোড লেগে হতে পারে । এক্ষেত্রে একটু নীমখোল পুঁতে দিলে কাজ দেবে।
৪. পাতা হলুদ হয়ে ছোটো ছোটো ব্রাউন স্পট হলে ওটা নিউট্রিএন্ট এর অভাব। এক্ষেত্রে একটু কম্পোস্ট মাটিতে পুঁতে দিন, গাছ ইমপ্রুভ করবে। রুগ্ন গাছে কোনোভাবেই একসাথে অনেকটা সার দিয়ে দেবেন না, গাছ নিতে পারবে না ।
( গাছপাকার জলবাগানের টিপস ৮) – জলের গাছের গামলায় শেওলা হবেই … শেওলা হওয়া কি খারাপ ?
১. মাটিতে অতিরিক্ত সার হয়ে গেলে শেওলা খুব বেশি হবে। মাটি থেকে সার জলে মিশবে, তার ওপর সূর্যের আলো পড়লে শেওলা হবে। তাই মিডিয়া যেভাবেই করুন না কেনো একদম ওপরের এক ইঞ্চি মাটি যদি সার বিহীন মাটি দেন তাহলে শেওলা অনেক কম হবে।
২.গাছ বড়ো হয়ে গেলে পাতার ছায়া থাকবে। সূর্যের আলো সরাসরি না পড়লে শেওলা এমনিতেই অনেক কম হবে। তাই গাছ বড়ো হয়ে গেলে শেওলা কমে যাবে।
৩. বৃষ্টির জলে শেওলা কমে যায়, তাই বর্ষাকালে শেওলা অনেক কম হবে।
৪. যে শেওলা জলের সারফেসে থাকে , হাত দিয়ে সরালে নিচের স্বচ্ছ জল দেখা যায় , সেটা জলের গাছের জন্য উপকারী শেওলা । এই শেওলা রেখে দিলে গাছের উপকার। জল ঠান্ডা থাকবে, জলে হিউমাস ইকোসিস্টেম ব্যাল্যান্স থাকবে, গাছ ভালো হবে।
যে শেওলা জলের নিচের স্তর থেকে একদম ওপরের স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে, জলের রং হালকা সবুজ হয় বা হাত দিয়ে তুলে ফিলামেন্ট এর মতো মনে হয় ওগুলো জলের গাছের জন্য খারাপ। এগুলো হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
অনেকে জল ওভারফ্লো করে শেওলা ফেলেন , এটা ঠিক না । শেওলার সাথে সাথে জলের মধ্যে দিয়ে পট থেকে নিউট্রিয়েএনট ড্রেন হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে গাছ অপুষ্টিতে ভোগে । খুব বেশি শেওলা হয়ে গেলে কাঠিতে করে তুলে ফেলে দিন। গাছ গ্রোথ নেওয়ার আগে পর্যন্ত গামলা পরিস্কার রাখুন ,এই সময় খুব বেশি শেওলা হলে গাছ দেরিতে গ্রোথ নেয়।
জলের গাছের গামলায় শেওলা না হওয়াটাও খারাপ ! শেওলা না হওয়া মানে আপনার মিডিয়াতে এমন কিছু রাসায়নিক মিশে আছে যেটা শেওলা হতে দিচ্ছে না । চাষের জমির মাটি নিলে বা পুরানো মাটির বাড়ির দেওয়াল ভাঙ্গা মাটি নিলে এরকম হয় । এক্ষেত্রে আপনার গাছ ভালো হবে না, পাতা হলুদ হবে , ফুল কম দেবে , ফুলের সাইজ ছোটো হবে।
জলের গাছ হিউমাস পছন্দ করে। যেকারনে পুকুরের পাঁকে গাছ ভালো হয়।
© গাছপাকা।

গাছ নিয়ে এইরকম মূল্যবান টিপস সরাসরি আপনার হোয়াটস্যাপ একাউন্টে পেতে আমাদের "গাছের পাঠশালায়" ভর্তি হতে পারেন। এই পাঠশালায় রোজ গাছ নিয়ে ছোটো ছোটো টিপস শেয়ার করা হয়। খুব সহজে ,কম যত্নে আর কম খরচে গাছ করা সম্ভব ! ভালো গাছ করাটা কোনো রকেট সাইন্স না , কিন্তু সঠিক যত্নটা জানা দরকার আর চর্চায় থাকাটা দরকার।

আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ।

আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ “গাছপাকার গাছের পাঠশালা” ।রোজ একটু একটু করে গাছ করা শিখতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

আমাদের ফেসবুক পেজ।

আমাদের ফেসবুক পেজ “গাছপাকা” । গাছ নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই পেজটি ফলো করতে পারেন।

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ।

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ “গাছের সমস্যার সমাধান ” । আপনার গাছের সমস্যায় পরামর্শ চাইতে এই গ্রুপে পোস্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
× Whatsapp