সবাই গাছ নিয়ে আদিখ্যেতা করে না ~ রাহুল বিশ্বাস

ভালোবাসা মানে সম্পর্ক, ভালোবাসার পরিধি মহাবিশ্বের মতোই বিশাল। ‘ভালোবাসা’ নামক বস্তুটিতে যতটা আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, তা আর অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। আর এই আত্মতৃপ্তির পরিপূর্ণ স্বাদ আপনি তখনই পাবেন, যখন এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকে আপনি নিঃস্বার্থভাবে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারবেন। ভালোবাসার অনেক রূপ, যার একমাত্র ভিত্তি বিশ্বাস। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ অনেক রকম ভাবে হতে পারে। কেউ কেউ ভালোবাসা থেকে গাছ লাগায়, গাছের পরিচর্যা করে। গাছের প্রতি কিছু মানুষের ভালোবাসা রয়েছে, কিন্তু মানুষের প্রতি গাছের ভালোবাসা আছে কিনা জানি না। হয়তো আছে। এই নিয়ে আজ একটি ঘটনা বলবো।

আমি গাছ ভালোবাসি তাই শুধুই বৃক্ষরোপণ করি না, তাদের যত্নআত্তি ও উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে সেখানে মাথা গলাই না। উদ্দেশ্য একটাই, পৃথিবীতে সুস্থ থাকতে হলে ৩০% বনাঞ্চল হওয়া খুব জরুরি। তবে আমার কোনো নার্সারি বা এন. জি. ও নেই। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে ডাক পেলাম বীরভূমের সিউড়ি জেলা সংশোধনাগারে আবাসিকেদের দিয়ে বৃক্ষরোপণ করা হবে। ২৬শে জানুয়ারির একটি কর্মসূচি। জেলা শাসক ভারতী ম্যাডাম আমার পূর্ব পরিচিত। তার ভাই আমার তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করে সাব-ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত। সেই সূত্রে ভারতী দিদির কাছে রাহুল ভাইয়ের একটা কদর আছে। আমিও তাঁর সম্মানার্থে প্রায় বিভিন্ন রকম ফুল ও অন্যান্য দেশীয় মোট ২০০ টি গাছ ও কিছু গাছের সার এবং ৩ জন সদ্য গাছপ্রেমীদের নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে আমি উপস্থিত হলাম। সেখানে গিয়ে পুরসভার চেয়ারম্যান মানব বাবু , জেল সুপার আব্দুল্লাহ বাবুর সাথে পরিচয় হলো। ছোট্ট ঘোষণা ও পরিচয় পর্বের মাধ্যমে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ৮০ জন আবাসিকদের মধ্যে গাছ ভাগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা হল। ভাগ করে দেওয়া হল সার, জল ও বুঝিয়ে দেওয়া হল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। কাজ শুরু হয়ে গেল। আমার ৩ জন গাছপ্রেমী অভিজ্ঞরা চিহ্নিত করে দিলেন কোথায় কোথায় কি কি গাছ বসবে।

আমি, ভারতী ম্যাডাম, জেল সুপার ও মহিলা ইনচার্জ জয়ন্তী ম্যাডাম তখন ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করছি। হঠাৎ একজন মহিলা ব্লক থেকে চিৎকার করে উঠলেন, “মেরে ফেললো রে, মেরে ফেললো!” আমরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম। কাছে গিয়ে দেখি প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী একজন মহিলা কয়েদি একটি বকুলচারা গাছকে বুকে আগলে ধরে তারস্বরে কাঁদছেন। পাশে থাকা এক মহিলা বলছেন, “এই চাটনি, কি হয়েছে তোর? এটা ওর গাছ, দিয়ে দে, দিয়ে দে বলছি!” আমাদের টিমে থাকা মহিলা ইনচার্জ জয়ন্তী ম্যাডাম গম্ভীর স্বরে ধমকে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে গাছটি দিতে বলে জোর করে কেড়ে নিতে গেলেন। ভারতীদি বললেন, “ছেড়ে দাও জয়ন্তী। ” দেখলাম অন্যান্য কয়েদিরা বেশ ভালোবেসে চাটনিকে আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দিলেন। কিন্তু উনি বকুল গাছটি ছাড়লেন না। শুনলাম এই মহিলা সবার জন্য বেশ ভালো রান্না করেন আর স্বনির্ভর প্রকল্পে ভালো আচার তৈরি করেন বলেই সবাই ওনাকে চাটনি নামে বিখ্যাত করেছেন। ভারতীদি চাটনিকে অফিস রুমে নিয়ে যেতে বললেন। ভারতীদি , জেল সুপার ও আমি খানিক পর অফিসরুমে উপস্থিত হলাম। জেল সুপার যেতে যেতে বলেছিল এই মহিলাকে রামপুরহাট মহকুমা সংশোধনাগারে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে আগের বছর পাঠানো হয়েছে। ইনি দুটি খুন করেছেন। কিন্তু খুব ভদ্র উনি। এই প্রথম এরকম আচরণ করলেন। সবাই ঘরে যেতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। সবাই চেয়ারে বসলাম। ওনাকেও চেয়ারে বসতে বলা হলো। উনি বসলেন। ভারতীদি বললেন, “তুমি ওর গাছ নিয়ে নিলে কেন? আর কাঁদছিলে কেন? তোমাকে কেউ মেরেছে?” ঊনি চুপ থাকলেন। ভারতী ম্যাডাম অনুরোধের সুরে বললেন, “আমাদের বলো প্লিজ। ” উনি একটু জল চাইলেন। দু ঢোক জল খেয়ে বললেন, “আমার নাম অতসী। জন্ম আলিপুরদুয়ারে।

বাবা ফরেস্ট অফিসার ছিলেন। কাঠ মাফিয়াদের গুলিতে মারা যাওয়ার পর মা আমায় নিয়ে ডানকুনি মাসির বাড়ি চলে আসেন। আমার বয়স তখন চার অথবা পাঁচ। তার বছর তিনেকের মধ্যে এক অজানা জ্বরে মা আমায় মাসির কাছে দিয়ে, না ফেরার দেশে চলে যান। মাসি তার নিজের সন্তানের সাথে আদর ও অতি যত্ন সহকারে আমায় সব দিক থেকেই শিক্ষিত করে তুলতে কোনোরকম দ্বিধাবোধ করেননি। মনের ভিতরের দুঃখ চাপা পরে যায় মাসির মাতৃসম স্নেহে।

যাদবপুর থেকে এম. সি. এ করার পর সল্ট লেকের একটি বহুতল বিশিষ্ট কোম্পানিতে কর্মজীবন শুরু হয়। অতসী একটি ফুলের নাম, হয়তো তাই, অথবা বাবা প্রকৃতি ভালোবাসতেন তাই সবুজের উপর হৃদয়ের টান সেই ছোটো থেকেই। এই জন্য অফিসের ঢোকার মুখের দেশি-বিদেশি ফুলের বাগান ও অন্যান্য বৃক্ষ আমায় খুব আকৃষ্ট করতো। অফিস শুরুর ৩০-৩৫ মিনিট আগেই উপস্থিত থাকতাম। ফুলের ঘ্রাণ, গুলমোহর গাছে ঘুঘুর ডাক, শালিকের চঞ্চল মনের খেলা, সারি সারি দেবদারু গাছের মাথা দোলানো, সর্বোপরি বাগানের মালীর মেঠো ভাষা আমায় মুগ্ধ করে তুলত। অফিসের বাগানে রোজ রোজ বসে থাকা একজন সুন্দরী যুবতীর এরূপ আচরণের জন্য, যাতায়াত রত বহুতল বিভিন্ন কর্মীরা আমায় হয়তো চিনত। কেউ কেউ আবার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন ও করত। কে কি ভাবল তার কোনো ভ্রুক্ষেপ আমার ছিলনা। এইভাবে একসাথে চলছিল আমার সুখানুভূতির কর্মজীবন। ভাগ্যের পরিহাস বা বিধির বিধান যাই বলুন কিছুদিন পর একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ সুঠাম রুচিমার্জিত বছর সাতাশের ছেলে আমার মতো প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন হল। বেশ কিছুদিন পর কথায়-কথায় জানতে পারলাম তার নাম সৌমাল্য। আমাদের অফিস বিল্ডিংয়ের নবম ফ্লোরে বছর দুয়েক আগে থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বাগানের মালী দাদাকে গাছের উন্নত ধরণের পরিচর্যার কথা, তার ব্যাঙ্গালোরের কলেজ বাগানের গাছের কথা, যেমন- দেশী-বিদেশী ফুলের নাম, গাছের নাম বলতেন, কোন গাছের কী উপকারিতা বলতেন, বাস্তু মত বলতেন। মালী দাদার সাথে আমিও মোহিত হয়ে শুনতাম। বুঝেছিলাম আমার মতো সেও প্রকৃতিকে অনুভব করে। ক্রমশ দুজনের ভালো বন্ধুত্ব হয়। সৌমাল্য বলত অতসী ফুলের কথা। অতসী ফুলের গন্ধে মাদকতা আছে বলে একে মদগন্ধা বলে। পৌরাণিক মতে দুর্গাপূজোতে এই ফুল প্রয়োজন। আরো কত কথা চলত এরম! ক্রমশ এই ভাবে চলতে থাকার ঠিক আট মাস পর বুঝতে পারি, অতসী ফুলের সঠিক স্থান এই মাল্যতে। আমার চব্বিশ বছর বয়সে মনের অজান্তে প্রেম হয়। এটা বয়সের দোষ না হলেও মনের দোষ বলা যেতে পারে। যাইহোক মাসি, মেসো, ভাই, সৌমাল্যের মা ও বাবা সবার মতামত নিয়ে শুভবন্ধনে জীবন বেঁধে গড়িয়ার ভাড়া করা আবাসনের নিবাসী হলাম। চোখের পলক পরার মতোই দুজনের দুটি বছর কাটল অফিস বাড়ি করে। বেশ দিন কাটছিল দুজনের। এবার বংশ রক্ষার তাগিদ এল, ভেবেচিন্তে আলোচনা দ্বারা স্থির হলো আমি কর্মজীবন পরিত্যাগ করে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে থাকব তাদের বীরভূমের ডাঙ্গাল নামক একটি গ্রামে। শ্বশুরের অ্যাসিড নিয়ে কারবার তাই শহরের জনজীবনকে দূষিত না করে, ডাঙ্গাল গ্রামের কম জনবসতিপূর্ণ স্থানে ধাতব রঙ করার বড় ফ্যাক্টরি ও বাসগৃহ একই জায়গায় গড়ে তুলেছিলেন। শ্বশুর শাশুড়ি আমার গড়িয়া আবাসনে বেশ অনেক বার এসেছেন কিন্তু ডাঙ্গাল গ্রামে ওটাই ছিল আমার প্রথম পদার্পণ। ঠিক হয়েছিল সৌমাল্য সপ্তাহান্তে দুদিন আবাসনে না ফিরে ডাঙ্গাল গ্রামেই থাকবে। নিজস্ব গাড়ি থাকায় যাতায়াতের অত সমস্যা হবে না। বাড়িটির দ্বিতলে একটি মাত্র ঘর, সামনেই ছিল ফ্যাক্টরি। সেখানে সর্বদা ইলেকট্রিক চুল্লী জ্বলে, বিভিন্ন অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ দ্বারা ধাতব রং হয়। তার ফলে বাড়ির সামনে অ্যাসিডে ঝলসে গেছে প্রকৃতি, সবুজের কোনো চিহ্ন ছিলনা। বাড়িটি আট কাঠা জায়গায় বড় পাঁচিল বেষ্টিত। আশেপাশে কোনো প্রতিবেশী নেই। ঘরের পিছনে অর্থাৎ রান্না ঘরের পরেই পাঁচিল বেষ্টিত বেশ ফাঁকা একটি জমি আছে। আগাছাময় সে স্থান ঘিরে রেখেছে একটি মাত্র প্রায় ২০ ফুটের বকুলফুল গাছকে। আর পাঁচিলের ওপারে বেশ বড় বড় গাছের জঙ্গল ও একটি ছোট জলাশয়। বাড়ির নর্দমা দিয়ে ওই অ্যাসিড মিশ্রিত জল জলাশয়ে মেশে। শ্বশুর শাশুড়ি ও সপ্তাহান্তে বর নিয়ে সংসার। তার সাথে অফিসের লোকজন এবং ফ্যাক্টরির কর্মীদের দুবেলা চা, টিফিন, এবং রান্না সব কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। তিন মাসের মধ্যেই সৌমাল্যের হাই সুগার ধরা পড়ায় সন্তান আগমনে ব্যাঘাত ঘটল। ৭-৮ মাস পরে বুঝতে পারলাম কর্তব্যরত হতে হতে নিজের ভালোমন্দ বলে আর কিছুই নেই। অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও কেউই জিজ্ঞেস করে না আমি কেমন আছি। সবার সময়মতো খাওয়া ঘুম ঠিক থাকল, শুধু আমারই সব হারিয়ে যেতে থাকল। কারো অবকাশ নেই আমার খবর নেওয়ার। শরীর খারাপ থাকলেও কাউকে বলে কোনো সুরাহা হতো না। সৌমাল্য বড় খিটখিটে হয়ে গেল, কোনো কথা শুনতে চায় না। স্পষ্ট বলে দিয়েছে তাকে অযথা ফোন করা বারণ। কিন্তু মনে যদি এসব ভাবনা প্রশ্রয় দিই, তাহলে কষ্টের বেড়াজালে জড়িয়ে যাবো। মনকে প্রশ্রয় না দিয়ে ভেবে নিলাম আমি বাড়ির বৌ, আমার কর্তব্য থেকে আমার তো পালাবার উপায় নেই। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দশ হাত দূরে থাকা বকুল গাছটির সাথে নিজের বড় মিল পাই। কোনো যত্ন নেই তাও সে নিজের খেয়ালে আপন হতেই ধরিত্রী মায়ের বুক থেকে উঠে এসে কর্তব্যরত। আমার মতোই ওরও ভালো মন্দ, প্রয়োজন অপ্রয়োজন দেখার কেউ নেই। একদিন বিকেলে রান্না ঘরের দরজা খুলে ওর কাছে হাজির হলাম। কাছে যেতেই একটা আলাদা অনুভূতি হল। সে যেন আমায় বলল, বন্ধুত্ব করবে !

আমায় মনের কথা বলবে। শালিক, বুলবুলি ও অন্যান্য পাখিরা তার বন্ধু, তার সাথেই থাকে। সেদিন বকুলের একটা মিষ্টি হাওয়া আমার মনকে অনেক শান্ত করে দিল। পর দিন সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে স্নানের আগে বকুল তলার চারপাশ পরিষ্কার করলাম ও নতুন বন্ধুকে উপহার স্বরূপ শুধু দুই বালতি জল খেতে দিলাম। বুঝতে পারলাম তাতেই সে বড়ই খুশি। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর পড়ন্ত বিকেলে বকুলের কাছে গিয়ে একটু মনের কথা বলি, পাখিদের কলতান শুনি, মাঝে মাঝে সে পাতা আর ফুল ঝরিয়ে আমার কথায় সাড়া দেয়। আমি রোজ কিছু ফুল নিয়ে আসি। অপূর্ব তার গন্ধ। কত ভালোবাসা মাখা। আমি আবার কোনোদিন মজার ছলে, তার কাছ থেকে জানতে চাই কি ব্যাপার ! পাঁচিলের বাইরের অশ্বত্থ , ছাতিম, বাবলা গাছগুলো ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কেন! সে লজ্জা পায় , আহ্লাদিত হয়। আমিও বলি স্কুল,কলেজ, পাড়ার ছেলেরা, প্রাইভেট মাষ্টার আমার উপর ক্রাশ খাওয়ার গল্প। ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে বাড়িতে এসে অজয়, সৌভিকদা আমায় প্রেম নিবেদন করেছিল। এরম গল্প চলতে থাকে। কত ছেলেমানুষি ছিল, আমার আর বকুলের মধ্যে। মা, মাসি, ভাই – সবার কথা বকুল জানে। এইভাবে চলতে থাকল আমার বিকেলগুলো, আমার জীবনের একরত্তি ভালো লাগা। কিন্তু সে সুখ ও বেশীদিন সইল না। একদিন শ্বশুর শাশুড়ি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বাগানে ওই বকুলগাছের কাছে যাওয়া তাদের একদম অপছন্দের। এমনকি সৌমাল্যও একই মত প্রকাশ করল। আমি তাদের বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলাম, আবদ্ধ ঘরে থাকতে আমার মন লাগে না , আর ছাদ অ্যাসিডের জারে ভর্তি থাকে, পা ফেলার জায়গা নেই! তার উত্তর আসে, এসি ঘরের সুখ পছন্দ হচ্ছে না! তার উপর ওই সময় জি- বাংলা চ্যনেলে “দিদি নম্বর ওয়ান” হয়, সেটা দেখলেই তো সময় কেটে যায়। ওই অনুষ্ঠান দেখেও তো অনেক কিছু শেখা যায়। তাছাড়া হাতের কাজকর্ম করা যায়। আমি চুপ থাকি, এরপর থেকে লুকিয়ে কয়েক মিনিট বকুলতলায় উপস্থিত হতাম। যেদিন যেতে পারতাম না , একা একা থেকে বকুলের কথা ভাবতাম। অনুভব করতাম আমি ওকে ভালবাসি। অনুভব করি, ও আছে বলেই আমি এখানে এখনো ভালো আছি। এই জীবনে আমার মনের কথা শোনানোর মতো আর কাউকে পাইনি। দূরে থাকলে অনেক মায়া বাড়ে। আমায় এমন ভাবে প্রেমে বেঁধে ফেলতে কেউ পারেনি। বকুলের কথা ভাবলে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বকুলকে জানাই তার কাছে আসতে মানা। সে কিছু বলতে পারেনা, হয়তো কষ্ট পায় মনে। আমি আবার তাকে বোঝাই, আমি বাড়ির বৌ। হয়তো তাঁরা ভালোর জন্যই বলছেন, তাই রোজ না এসে মাঝে মাঝে আসব। সে তাতেই আনন্দে ফুল ঝরিয়ে সম্মতি জানায়। এই ভাবে কিছুদিন চলার পর এক শনিবার রাতে সৌমাল্যের উপস্থিতিতে তিনজন আলোচনা করে ঠিক করলেন বকুল গাছ টা তাদের কোনো কাজের নয়, কেটে ফেলাই শ্রেয়। আমার মাথায় বিনামেঘে বজ্রপাত হল! শাশুড়িকে বললাম, “কি বলছেন মা! বাবার প্রস্রাবে শিথিলতার সমস্যাতে বকুলের ছাল চটকে জলে সিদ্ধ করে, সেই জল খেয়ে বাবার রোগ কমেছে। আবার আপনার দাঁতে পোকা গর্ত। বকুলের ছাল জলে সিদ্ধ করে ২ সপ্তাহ ব্যবহার করেই কিন্তু আপনি ভালো আছেন। ” অমানবিকতায় ঢাকা পড়ে গেল আমার আর্তি। শেষ পর্যন্ত স্থির হল তাকে বিক্রি করা হবে। সে রাতে ঘুম আসেনি আমার, সারারাত ভেবেছি তাকে কোথায় লুকাবো। তাকে ছাড়া আমি ভালো থাকব কি করে! সকাল হতেই বকুলের কাছে ছুটে গিয়ে সব বলি, তার এই সর্বনাশের জন্য আমি দায়ী। তাই আমি আর আসব না। বিকেলে গাছ কেনার লোকজন আসে ঠিক হয়ে যায়, পর দিন নিয়ে যাবে গাছ কেটে। আমি পাগলের মতো ছুটে যাই, পাখিদের বলতে থাকি তোমরা সন্তান সন্ততি নিয়ে পালাও, বকুল যে আর থাকবে না। সেই রাতে বকুলের জন্য মন অস্থির হয়ে ওঠে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বরকে বশ করার তাগিদে শরীরের রস, মন, কামুকতা দিয়ে ওকে সুখের অনুভূতি দিয়ে অনুরোধ করি, কথা দিই আমি আর বকুলতলায় যাব না। এই আশায়, যদি বকুলের উপর একটু সহৃদয় হয়। এই সর্বনাশ যাতে আটকায়। সুখের অনুভূতিতে বরের সম্মতিতে আশ্বস্ত হই। পরেরদিন সকাল হতেই ও পূর্বের ন্যায় অফিস চলে যায়। সকাল ১০ টায় গাছ কাটার কসাইরা হাজির হয়। আমি অনেক আশায় সৌমাল্যকে ফোন করতে সে বলে, “বেশি ন্যাকামো কোরো না।” শেষ পর্যন্ত মা-বাবার পা জড়িয়ে ধরি। তাও কাজ হয় না। আমি রেগে গিয়ে বলি, “গাছ কাটা যাবে না। ও এমনি থেকেই হয়েছে, এই গাছের মালিক আপনারা নন। পৃথিবীর কোনো সরকার গাছ কাটতে পারেনা। আমি আইনের রাস্তা নেব। ” ওরা আমায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে বন্দী করে দেয়। কসাইরা অবলীলায় গাছ কেটে ফেলে নিয়ে চলে যায়। সেদিন আমি ঘরবন্দী থাকলাম, শুধু চোখের জল ছাড়া আর কিছুই করার থাকলো না। বিকেলে ঘর খোলা হলে অভুক্ত অবস্থায় বকুলের কাছে ছুটে যাই। কি ভয়ানক দৃশ্য! চারিদিকে নিস্তব্ধ পরিবেশ। বকুল আর নেই। ওর শিকড় উপড়ে রেখে শুধু শিকড়টা এক পাশে ফেলে রেখেছে। আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। মনে হচ্ছিল, আমার বেঁচে থেকে আর কি হবে। মা মরার পর মাকে জড়িয়ে অতো কাঁদিনি সেদিন ওকে জড়িয়ে যা কেঁদেছিলাম। দুদিন কিছু খাইনি, নিয়মানুসারে সংসারের কাজ করেছি, রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাইরে

তাকাতে পারতাম না। দিন চলে যায় রাত চলে যায়, অশ্রু ঝরতেই থাকে। প্রায় ২০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর অনেক কষ্টে নিজেকে অনেক বুঝিয়ে আবার সব মানিয়ে নিতে শুরু করলাম। বিকেলে ওই শুকিয়ে যাওয়া গুঁড়ির কাছে এসে একটু কাঁদতাম ওকে জড়িয়ে ধরতাম। আমার হারানোর আর কিছু নেই। কিন্তু কিছুতেই বুকের ভেতরে আটকে থাকা শক্ত পাথরটা বের করতে পারলাম না। সেই সপ্তাহে সৌমাল্য বাড়িতে আসলে বললাম আমি মাসির বাড়ি যাবো, সেখানে কিছুদিন থাকবো। সৌমাল্য বলেছিল, যেতে তুমি পারো কিন্তু মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। মনের ভেতরে স্থির করেছিলাম শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, আবার নতুন করে কর্ম জীবন শুরু করবো। এইখানে থাকলে শেষ হয়ে যাবো। দুদিন পর আমার কাছে জমানো ফুলগুলো থেকে কিছু শুকনো ফুল দিয়ে বকুলতলায় বিদায় জানাতে গেলাম। বলে এলাম, “আমি চললাম। যেখানে তুমি নেই সেখানে আমি থেকে কি করবো! আগের মতো আবাসনে থাকব। কিন্তু জেনে রেখো, আমি ভালোবাসি তোমাকে, তোমাকে সবসময় মনে রাখব, বাকি জীবনটা তোমার হয়েই থাকব। কাছে আর দূরে যেখানেই থাকি, আমার এই মন তোমার। ” পাঁচিলের বাইরের বকুলের সকল বন্ধুদের ভালো থাকার আবেদন জানিয়ে বিদায় নিলাম। রাতে ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম। মনের সাথে অনেক লড়াই করার পর , খাবার টেবিলে শ্বশুর শাশুড়িকে জানিয়ে দিলাম মনের কথা। পরের দিন রামপুরহাট থেকে ট্রেন ধরে কিছুদিন ডানকুনি থাকব। তারপর গড়িয়ার আবাসনে থাকব। তারা শুনেই চিৎকার করতে শুরু করে দিলেন। শাশুড়ি বলে দিলেন, এক পা বাড়ির বাইরে রাখা যাবে না। শ্বশুর বললেন, যদি এই নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করি , অ্যাসিড ড্রামে পুরে দেবেন, শরীরের হাড়গুলোও গলে যাবে। আমি বেশি কথা না বাড়িয়ে সৌমাল্যকে ফোন করে সব বললাম। সে বলল, মা বাবা যা বলছে শুনতে। সে সপ্তাহান্তে এসে নিয়ে যাবে। আবারও শুধু প্রতিশ্রুতি! প্রচন্ড ঘৃণা হল। আর সহ্য করতে না পেরে ভাবলাম ভাইকে বলি, তোর দিদি ভালো নেই রে! আমায় নিয়ে যা। ভাইকে ফোন করলাম। কিন্তু ভাগ্য নিষ্ঠুর হলে যা হয়। ফোন ভাইয়ের বৌ ধরল, বলল ভাই বেরিয়েছে, অন্যান্য কথা হল, আসল কথা আর বলা হল না। রাতে ভাই আমায় না পেয়ে শাশুড়ির ফোনে কল করেছিল। আমি জানতাম না কি কথা হয়েছিল। রাত তখন ১ টার কাছাকাছি, আমি ঘুমিয়ে আছি, সেই সুযোগে শ্বশুর শাশুড়ি আমার ঘরে ঢুকে বিছানায় ও আমার ব্লাউজের পেছনের দিকে গাড়ির পেট্রোল লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। জ্বলনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দগ্ধ অবস্থায় তাদের দিকে যেতেই তারা উপরের ঘরে পালিয়ে যায়। রাস্তায় বেরোনোর দরজায় তালা থাকায় পুড়তে পুড়তে আমি ছুটে চলে যাই রান্নাঘর দিয়ে বাগানে, ওদের ভয়ে বাইরে থেকে রান্নাঘর আটকে দিয়ে অন্ধকার আগাছার মধ্যেই শুয়ে পড়ি যন্ত্রণায়। কিছুক্ষনের মধ্যে বাড়ি জ্বলতে জ্বলতে অ্যাসিডের সংস্পর্শে তান্ডব লীলা চলতে থাকে, বিস্ফোরণ ঘটে, আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে দেখি রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে পুলিশ বেষ্টিত চারিদিকে আমি বেডে শুয়ে আছি। অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছিল। পুলিশ জানায় তার বর জানিয়েছেন আমি তার বাবা-মা কে পুড়িয়ে মেরেছি। সৌমাল্য আমার জ্ঞান ফিরে আসার কথা শুনেই দৌড়ে আসে আমাকে মারতে উদ্ধত হয়। দু-চারটে চড় মারার পর পুলিশ তাকে সরিয়ে দেয়। তারপর থেকে নিস্তব্ধ হয়ে যাই। আমার আর বাঁচার শক্তি ছিলনা। মাসি, ভাই খুব চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু “অর্থের জন্য শ্বশুর শাশুড়িকে পুড়িয়ে মারল চরিত্রহীন গৃহবধূ” খবরের কাগজ গুলোর হেড লাইন গুলো আমার বিরুদ্ধে চলে যায়। ৭ বছরের জেল ও ১০ হাজার টাকার জরিমানা হয়। চরিত্রহীন বলে ডিভোর্স কাগজে সই করতে হয়। আমার সত্য ঘটনা শোনার মতো কেউ ছিলনা। নিজের পক্ষের উকিল গাছের কথা শুনে অনেক হেসেছিল। বলেছিল অন্য গল্প ফাঁদতে হবে। আইনে এটা জমবে না। ” বলতে বলতে অতসী দেবীর চোখ থেকে নেমে আসা জল গাল বেয়ে পড়তে থাকল। সমস্ত কথা শুনে আমরা প্রায় সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সবারই মাথা নত। কিছু বলার ভাষা পেলাম না। আমি ভারতী ম্যাডামকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

তখন বিকেল ৩ টের কাছাকাছি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম, খেয়েছে কিনা, সে সম্মতি দেওয়ায় তাকে বললাম, “গুগল ম্যাপ খুলে ডাঙ্গাল গ্রামে চলো”। ডাঙ্গাল গ্রামে পৌঁছে সৌমাল্য রায়ের বাড়ির খোঁজ শুরু করলাম। উদ্দেশ্য একটাই, সত্যতা যাচাই। চোখের জল নিশ্চয়ই সত্য কথা বলেছে। কিন্তু কথায় বলে, মেয়েদের চোখের জল সহজে বিশ্বাস করতে নেই। তাও দোষীর মুখে শোনা! শুধু গল্প শুনে বসে থাকার মানুষ আমি নই। যদি ঘটনা সত্যি হয় তবে সৌমাল্যকে বোঝাবো, সে জীবনে কি ভুল করেছে। সৌমাল্যকে না পেলেও কেউ তো কিছু বলবে। ডাঙ্গাল গ্রামে পৌঁছে খোঁজ শুরু হল। অনেক খোঁজার পরেও কেউ সঠিক ঠিকানা দিতে পারল না। অবশেষে তপন মুন্ডা নামে একজন, বয়স বছর সত্তর ছুঁই ছুঁই, এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন ওনাকে জিজ্ঞেস করতে।

ওনাকে গাড়ি থেকে বসেই বললাম সৌমাল্য রায়ের বাড়িটি দেখিয়ে দিতে পারবেন কিনা। শুনে উনি গাড়ি থেকে নামতে বললেন। উনি আর কোনো কথা না বলেই নিজে বাড়ির ভেতর থেকে হাতে তিনটে চাবি ঝুলিয়ে ওনার পেছনে আসতে বললেন। আমি হাঁটতে থাকলাম। ড্রাইভারও আমাদের অনুসরণ করল। মাটির রাস্তা দিয়ে কিছুটা হাঁটার পর একটা পুরোনো মন্দির থেকে বাদিকে বাঁক নিয়ে প্রায় শেষ প্রান্তে ৫০ কি ৬০ ফুট দূরত্বে একটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বেশ বড় জায়গায় এসে থামলাম। লোহার টিনের বিরাট দরজা। একটি বড় লরি সহজেই ঢুকতে পারবে। আমার মনে হল, আমি বেশ কিছু দিন ধরে এরকম জায়গা খুঁজছিলাম রেলের শেডের হুক, পেরেক এসবের ফ্যাক্টরি করার জন্য। জিজ্ঞেস করলাম, “কাকু, সৌমাল্য বাবু এই বাড়িতে থাকেন না?” উনি বললেন, “সে আবার কে?” আমি বললাম, “যার বাবার অ্যাসিডের কারবার ছিল, ছেলে বাইরে পড়াশোনা করতেন। ” উনি বললেন, “ও তাই বলেন, বড় বাবু তো মারা গেছেন। আর ছোট বাবু এই জায়গা পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলেকে বিক্রি করে বৌ নিয়ে চলে গেছেন কেরলে। আপনি জায়গা কিনতে আসেননি?” বিক্রির কথা শুনে মনে আনন্দের জোয়ার বইল। ঊনি আবার বললেন, “আপনি কি রাজবংশী দালালের লোক? তাই যদি হয়, এ জমি কিনতে গেলে হাজার টাকা আমায় দিতে হবে , তবেই গেট খুলব। ” আমি বললাম, “না না আমি কোনো দালালের লোক নই। যদি দামে পোষায় তোমায় দশ হাজার টাকা দেব।” উনি খুশিতে পারলে দরজা ভেঙে ফেলে আমায় ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু তালায় জং থাকায় ৩ টের কোনো চাবিতেই খুলতে পারলেন না। আমিও চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। কতদিন পর খুলছেন প্রশ্ন করাতে বললেন, বছর ঘুরে গেছে কেউ কেনে না। দাম কত জিজ্ঞাসা করতে বললেন, পাঁচ লাখ মত হবে। বললাম, “এই গ্রামের ভিতরে এত দাম?” মুখের কাছে এসে বললেন, “আপনি চার বলবেন ঠিক দিয়ে দেবে। ” বললাম, “তবে খুলে লাভ নেই, আগে পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলের কাছে চল। ” গাড়িতে উঠলাম। পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ি উপস্থিত হয়ে জায়গার কাগজপত্র দেখলাম। দেখে ঠিকই মনে হল, শেষ পর্যন্ত দাম ২ লাখ ৯০ হাজার ঠিক হল। পরদিন কাগজ ভেরিফিকেশন হবে তারপর কিছু টাকা দিয়ে বায়নানামা করতে হবে। ওই বৃদ্ধ তপন বাবুকে ৫০০ টাকা দিয়ে বললাম, “তুমি আরো দশ হাজার পাবে। তুমি এই জায়গার দেখাশোনা করবে। কাল আবার এসে টাকা দেব। সকালে তুমি তালা খুলে লোক দিয়ে সব পরিষ্কার করিয়ে রাখবে। ” আমি কলকাতায় না ফিরে তারাপীঠের একটি চেনা হোটেলে থাকলাম। পরের দিন কাগজপত্র যাচাই করে বায়নানামাতে সই করলাম এবং কাগজ নিয়ে উপস্থিত হলাম ওই বাড়িতে। ঠিক করলাম একবার দেখে ফেরৎ যাব কলকাতা। আবার ২০ দিন পর এসে দলিলনামা করে নেব। মনে মনে ভাবছিলাম স্বপ্নগুলো পূরণ এইভাবেই হয়। শুধু উদ্যোগ নিতে হয়। প্রচুর টাকার প্রজেক্ট করতে হবে। বাড়ির গেট খোলা ছিল। দুজন কাজ করছে সকাল থেকে, প্রচুর আগাছা কেটে স্তুপ করে রেখেছে। ভালো করে লক্ষ্য করলাম সেদিনের বিস্ফোরণে বাড়ি এক প্রকার ধসে গেছে। ওই বৃদ্ধ কর্তা আমায় ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। বাড়ি দেখে অতসী দেবীর বলা গল্প মনে পড়ছিল। ছাদের সিঁড়ি অর্ধেক ঝুলছে, একদিকে বাড়ির কোনো ছাদ নেই , শুধু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। ছোটো বারান্দা পেরিয়ে ঝুলে ভরা একটা ছোটো ঘরের মধ্যে দিয়ে পিছনে প্রবেশ করলাম। বুঝলাম এই সেই রান্নাঘর। সামনের দিকের কিছুটা আগাছা পরিষ্কার করেছে। তবে কাজ চলছে। বাকি আগাছার মধ্যে দিয়ে একটি বকুল গাছ দেখে গা শিউরে উঠল। তাড়াতাড়ি এই আগাছা পরিষ্কার করতে বললাম। নিজেই একটি কাটারী দিয়ে আগাছা কেটে উপস্থিত হলাম বকুল গাছের কাছে। কাছে যেতেই দেখতে পেলাম একটি উপরানো আলগা শিকড়ের চাঁই থেকে বেশ মজবুত কাষ্ঠ নিয়ে প্রায় নয় কি দশ ফুটের বেশ গোল হয়ে নিজেকে মেলে ধরেছে। মুহূর্তের মধ্যে নিজের লোভ লালসা, ফ্যাক্টরি সব ভুলে গেলাম। ওদের ডেকে বললাম, “এ কি করে সম্ভব হল? এই শুকনো শিকড় থেকে গাছ!” ওরা কেউ কিছুই বুঝল না , উপরন্তু ভাবল আমি গুপ্তধন খুঁজছি। ওদের একজনকে মাটি দেখিয়ে বললাম, “একটু খুঁড়ে দাও সাবধানে। ” মিনিট দুই খোঁড়ার পর আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম পাঁচিলের ওপারের অশ্বত্থ গাছের দিকে। অশ্বত্থ গাছের শিকড়, বকুল গাছের শিকড়ে জড়িয়ে বাঁচার রসদ জুগিয়েছে। বড়ই বিচিত্র এই বাড়ি! একজন বকুল কে ভালোবেসে দন্ডিত, একজন ভালোবাসার নামে প্রতারণা করে নতুন সংসার পেতেছে, আর আরেকজন ওপার থেকে এসে নিজের ভালোবাসাকে জীবন দান করেছে। মাথা কাজ করছিল না। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে, জেলাশাসক ভারতী ম্যাডাম কে আসতে অনুরোধ করলাম। লোকেশন শেয়ার করে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম এলে সব কিছু খুলে বললাম। জায়গা কেনার কথা বলতে ম্যাডাম নিজেও দেখে অবাক হয়ে যান। আমায় বলেন, “রাহুল, সবার আগে জায়গা কেনো। পরে এখানে আসবে। এসব ভাববে। ” আমি কলকাতায় ফিরে এসে মনস্থির করি এই বাড়ি অতসী দেবীর।

এরপর ১০ দিনের মধ্যে বাড়ি কিনে, প্ল্যান মাফিক ভারতী ম্যাডামের অফিস পৌঁছালাম। সেখান থেকে দুজন বিডিও অফিসের কৃষি বিভাগের লোক নিয়ে হাজির হলাম ওই বাড়িতে। তারা দেখে শুনে বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু কথা বললেন যা গল্প শোনার পর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। সেটা আমিও দেখেছি বকুলের একটি শিকড় অ্যাক্টিভ ছিলো মাটির সাথে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেলো পাঁচিলের ওপারের গাছের শিকড় আসলো কেন? আমি ও ম্যাডাম দুজনেই অশ্বত্থ গাছকে শতকোটি প্রণাম জানালাম। বুঝলাম আসলে পৃথিবীটা তোমাদের ছিলো, আমরা অবাঞ্ছিত। যত দিন থাকবো তোমাদের উপর অত্যাচার করে যাবো। আমাদের কার্যকলাপ বলে দিচ্ছে আমাদের ধ্বংস আগত। যাই হোক সেদিন ম্যাডামের সাথে চায়ের টেবিলে বসে ঠিক করলাম এই বাড়ি অতসী দেবীকে গিফ্ট করা হবে। তার আগে কাউকেই এই বিষয়ে কিছু জানানো হবে না। ক্রমে ক্রমে আমি বাড়িটি সম্পূর্ণ ভেঙে বাড়িটি বিভিন্ন গাছের সমারোহ করেছি। একটি ছোট্ট আশ্রম মতো করার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছি। যতটা সম্ভব বকুল গাছের যত্ন নেওয়া হয়েছে। আমি প্রায় গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি, অতসী দেবীর কথা বলি, কিন্তু কোনো দিন সাড়া দেয়নি। সাড়া দেবেই বা কেন! আমরা সকলেই অমানবিকতা নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে সুখে থাকি। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের অতীত থেকেই দিয়ে আসছে। আমরা সকলেই প্রয়োজনীয়তা , অভিজ্ঞতা, শিক্ষা সব পেয়েও সব জেনেও চোখ বুজে অন্ধ হয়ে থাকি। আর স্বপ্ন দেখি নতুন ভোরের। অতীতের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”। কবিতাটিতে প্রাকৃতিক বীভৎসতার বিরুদ্ধে প্রকৃতির সাথে জীবকুলের ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছিলেন, আমরা কি আদৌ পেরেছি! আমরা তুলসী তলায় একটি বাতি জ্বালাতে গেলে হাজার প্রশ্ন করি! লাভ-লোকসানের হিসাব চাই। শুধু এইটা বুঝে মেনে নিতে পারিনা সারাদিন যে অক্সিজেন পেয়ে বেঁচে রইলাম তার জন্য ছোট্ট একটা গাছকে সম্মান জানানো দরকার। বাতি না হলেও একটা প্রণাম দিয়ে সম্মান জ্ঞাপন করতে পারি। আজ হয়তো বুঝব না, বুঝব একদিন। সেই দিন আগত। বেশি দেরি নেই, ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। টাকা দিয়ে অক্সিজেন কিনতে শুরু করে দিয়েছি। ভাবতে অবাক লাগে, যে বাংলায় গাছের এত সমারোহ ও কদর ছিল, সেখানে অক্সিজেন ভিক্ষের জন্য হাট বসছে। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের কাছে আমরা ক্রমশ হেরে যাচ্ছি। নিজেদের যত উন্নত মনে করছি মানবিকতা তত তলানিতে পৌঁছাচ্ছে। এই ঘটনাটি থেকে আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করি, মানুষ সহ সকল প্রাণীকুল যদি তাদের নিজেদের ভাষা বোঝে, তাহলে গাছেরাও তাদের নিজেদের ভাষা বোঝে। আবার মায়েরা যেমন তার শিশুর ভাষা বোঝে এবং কিছু মানুষ পশু-পাখিদের ভাষা বোঝে, তেমনি কিছু মানুষ গাছের ভাষা বুঝতে পারে।

যাইহোক, শুধু অপেক্ষা করে আছি, ২০২৩ সালের ৩রা মার্চ এর। ওই দিন অতসীদেবী অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবেন। ঠিক করেছি সেইদিন ওনাকে আমাদের সাথে নিয়ে আসব। দেখব ফিরে পাওয়া মিলনের প্রতিক্রিয়া আর বাকি জীবন উপভোগ করব তাদের দুজনের অবাধ ভালোবাসা। এটাই হবে ভালোবাসার মন্দির যেখানে দেবতার আসনে বসবে প্রকৃতি। ঠিক করেছি আশ্রমের নাম রাখব “বকুলতলা”।

লেখক/লেখিকা ~ রাহুল বিশ্বাস

লেখাটা ভালো লাগলে শেয়ার করতে চাইলে একদম ওপরে শেয়ার বাটন আছে। 

 

গাছ নিয়ে মূল্যবান টিপস সরাসরি আপনার হোয়াটস্যাপ একাউন্টে পেতে আমাদের "গাছের পাঠশালায়" ভর্তি হতে পারেন। এই পাঠশালায় রোজ গাছ নিয়ে ছোটো ছোটো টিপস শেয়ার করা হয়। খুব সহজে ,কম যত্নে আর কম খরচে গাছ করা সম্ভব ! ভালো গাছ করাটা কোনো রকেট সাইন্স না , কিন্তু সঠিক যত্নটা জানা দরকার আর চর্চায় থাকাটা দরকার।

আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ।

আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ “গাছপাকার গাছের পাঠশালা” ।রোজ একটু একটু করে গাছ করা শিখতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

আমাদের ফেসবুক পেজ।

আমাদের ফেসবুক পেজ “গাছপাকা” । গাছ নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই পেজটি ফলো করতে পারেন।

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ।

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ “গাছের সমস্যার সমাধান ” । আপনার গাছের সমস্যায় পরামর্শ চাইতে এই গ্রুপে পোস্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
× Whatsapp