“সহস্রদল” বা “হাজার পাপড়ির পদ্ম”

আজ আপনাদের একটা গল্প শোনাবো। রূপকথার মতো মনে হলেও গল্পটা কিন্তু আসলে সত্যি ….আর গাছের জগতে এর থেকে সুন্দর , রোমহর্ষক গল্প বোধহয় আর নেই।
যাঁরা একটা হলেও বাড়িতে পদ্ম গাছ লাগিয়েছেন তাঁরা জানেন এর ফুলের রূপটা কিরকম।
যতই গোলাপ , ডালিয়া, জবা ফুল ফোটান ….পদ্ম ফুল সবার থেকে আলাদা। যেদিন বাড়িতে প্রথম পদ্মফুল ফোটে সারা জীবন মনে রাখার মত একটা দিন হয়ে যায় ওই দিনটা।
আমার বাড়িতে , বাগানে অজস্র পদ্মগাছ। এক এক সময় ছাদের মেঝেটা দেখা যায় না । পাতায় আর ফুলে ভরে থাকে। কিন্তু সবার থেকে আলাদা একটা ভ্যারাইটি …. নাম “সহস্রদল” বা “হাজার পাপড়ির পদ্ম” ।
এমনিতে নর্মাল পদ্মের ভ্যারাইটি গুলোর পাপড়ি সংখ্যা ১৫০ এর মধ্যে । পদ্মের ভালো ভ্যারাইটিগুলোর পাপড়ি সংখ্যা ওই ৩০০ থেকে ৫০০ র মধ্যে ঘোরাঘুরি করে । কিন্তু সহস্রদল হতে গেলে হতে হবে অন্তত ১০০০ পাপড়ি !
পৃথিবীতে এই সহস্রদল পদ্মের ভ্যারাইটি কিন্তু হাতেগোনা। আমার জানা সহস্রদল পদ্ম গাছের ভ্যারাইটি গুলো হলো Qianban Lian, Zhonzhang Hongtai , Yilliang Thousand Petal আর এই Zhizhun Qianban ।
এই হাতে গোনা চারটে ভ্যারাইটির মধ্যে সবথেকে সুন্দর দেখতে আর সবথেকে বেশি পাপড়ি Zhizhun Qianban এর… পরিণত ফুলে প্রায় ১৬০০-১৭০০ পাপড়ি এর।
আজ এই Zhizhun Qianban এরই গল্প শোনাবো আপনাদের। চাইনিজ ভাষায় “Zhizhun” এর মানে হলো রাজকীয়/ “যার স্থান সবথেকে উচুতে” আর Qianban এর অর্থ হাজারটা পাপড়ি ….. দুয়ে মিলে তাহলে দাড়ালো “সম্মানিত রাজকীয় হাজার পাপড়ির পদ্ম”! বা ” Ultimate Thousand Petal ” / UTP
মানে যার পরে পদ্মের জগতে আর কেউ নেই!
সত্যি তাই !
আমার কাছেই প্রায় ষাট রকমের পদ্মের ভ্যারাইটি আছে। কোনো ভ্যারাইটির পদ্ম ফুলই তিনদিনের বেশি ভালো থাকে না। তিনদিন পর থেকেই ধীরে ধীরে রং হালকা হয়ে আসে.. পাপড়ি আলগা হয়ে যায় … শেপ নষ্ট হতে থাকে।
কিন্তু এই UTP র ফুল থাকে সাত দিনেরও বেশি … ফুলটা ঠিকভাবে ফুটতেই সময় নেয় তিনদিন। আর কি সুন্দর এলাচ এর মতো মিষ্টি সুগন্ধ । সবদিকথেকেই সেরার সেরা।
তো এই UTP এলো কোথা থেকে …. সেটা অজানা। যেটুকু এখনো পর্যন্ত জানা গেছে সেইটুকু বলছি ।
এই ভ্যারাইটিটা পাওয়া গেছে দক্ষিণ চীনের Guanzhau প্রদেশে । এক ছোট্ট নার্সারির মালিক Changxin Chen এর থেকে।
উনিও জানেন না এই ভ্যারাইটিটা এসেছে কোথা থেকে …শুধু এইটুকু বলতে পেরেছেন যে তিরিশ সেন্ট আমেরিকান ডলার দিয়ে একটা ছোট্ট রাইজোম তিনি কেনেন Daliang of Shunde থেকে। সালটা ১৯৮১।
রাইজমটা দেবার সময় বিক্রেতা তাকে বলেন এই পদ্মের সঙ্গে একটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে ।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সালে চিন দেশে নাগরিকদের গার্ডেনিং করার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিলো। The Great Proletarian Cultural Revolution!
এই দশ বছরে পার্সোনাল কালেকশনে থাকা অজস্র গাছপালা চীনের মানুষ শাসকের ভয়ে নষ্ট করে ফেলেন । কিন্তু ভাগ্যচক্রে অনাদরে এই Zhizhun Qianban বেঁচে যায় এই Revolution থেকে …. একটা পাথরের শস্যদানা পেষার গামলায়!
এর পরের হাতবদলটা হয় ২০০৮/২০০৯ সালে। South China Botanical Garden, Chinese Academy of Sciences এর Daike Tian নামে এক তরুণ রাইজম সংগ্রহ করেন Dr Lei Chen এর থেকে , Dr Lei Chen সংগ্রহ করেছিলেন Changxin Chen এর থেকে।
Tian এর ভাষায় –
“While most ornamental plants were destroyed during the upheaval, one lotus plant in a small garden miraculously survived because it was planted in a heavy stone “ponder”, a large mortar-like utensil used for grinding food. “
“The cultivar had not been documented and the true history, creator, original owner, and name of the lotus cultivar are still unknown,” Tian said. “Therefore, it was given the name of ‘Zhizun Qianban’ based on morphological traits.”
তাই Zhizun Qianban নামটা Tian এর দেওয়া। সুন্দর নামকরণ ।
Tian আর তার বন্ধু Ken Tilt (from the Department of Horticulture at Auburn University) এই অনিন্দ্যসুন্দর পদ্মটিকে জগতের সামনে তুলে ধরেন HortScience এর প্রদর্শনীতে।
কিন্তু এটা ভারতে এলো কিভাবে?
এটা ভারতে আসে কেরালার কোচি নিবাসী গনেশ আনন্দকৃষ্ণন এর হাত ধরে। খুব ভুল না জানলে উনি রাইজম পান Daike Tian এর থেকেই!
২০১৭ সালে ভারতবর্ষের মাটিতে ত্রিপুরাতে প্রথম ফোটে এই Zhizhun Qianban বা Ultimate Thousand Petal (UTP) , তারপর ২০২০ সালে কোচিতে নিজের বাড়ির ছাদে আবার এর ফুল ফোটাতে সক্ষম হন।
অনেকেই বলবেন কি হবে এসব জেনে? ফুল তো ফুলই…কিন্তু একটা গাছের পিছনে এই সুন্দর ইতিহাসটা জানবেন না ?
এই গাছ বাড়িতে নিয়ে আসা মানে শুধু একটা গাছ নিয়ে আসা না… একটা জলজ্যান্ত ইতিহাসকে বাড়িতে নিয়ে আসা ! তফাৎ নেই???
দেড় হাজার বছর আগে চীনের সাহিত্যে Qianban Lian এর উল্লেখ আছে… মনে করা হয় Zhizhun Qianban এর ট্র্যাডিশন আরও পুরানো…সবথেকে প্রাচীন এই জাত।
সবথেকে মজার ব্যাপার , এটা থেকে কেউ আজ পর্যন্ত হাইব্রিড বানাতে পারলো না। এমনিতে পদ্মের হাইব্রিড বানানো খুব সহজ। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে UTP থেকে হাইব্রিড আজ পর্যন্ত কেউ বানাতে পারেনি। বোধহয় কোনো জংলী পদ্মের ভ্যারাইটি থেকে প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি হয়েছে এই UTP ।
আসলে প্রকৃতিও মাঝে মধ্যে নিজেকে জাহির করে … নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে যাতে কেউ বিকৃত না করতে পারে তাই এর জিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে গুপ্তমন্ত্র! এই গাছের বীজও হয় না। গাছ হয় একমাত্র রাইজম ডিভিশন থেকে..
এমনিতে হাইব্রিড ভ্যারাইটির পদ্ম ছোটো গামলায় বসালেও ৪৫ দিনের মধ্যে ফুল দিয়ে দেয়। তবে এই ভ্যারাইটিটা অনেকের কাছেই ফুল দিতে চায় না।
আমিও দু বছর ধরে লেগে থেকে তারপর ফুল পেয়েছি। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কেনো ফুল দিচ্ছে না।
অবশেষে একদিন হঠাৎ করেই একটা ভুল থেকেই আবিষ্কার করেছি ভুলটা কি হচ্ছিল ! এই ভ্যারাইটিটাকে পুকুরে বসিয়ে দিন , সুন্দর ফুল দেবে। কিন্তু ছোটো গামলায় ফুল পাওয়ার জন্য কিছু স্পেশাল যত্ন আছে।
অনেকে বলবেন ছোটো গামলায় ফুল হয়না । ভুল ধারণা। আমি বারো ইঞ্চি গ্যামলাতেও একে ফুল দিতে দেখেছি। আমার হিসাব মতো ছোটো গামলাতেও ফুল দেবে তবে একটু দেরীতে দেবে , যদি ঠিকঠাক সবকিছু করতে পারেন। সেরা জিনিসের জন্য চাই একদম পারফেক্ট হিসাব, একটু খাবার কম বা বেশি হলে হা করে বসে থাকতে হবে কবে ফুল দেবে … যেমন আমি বসে ছিলাম তিন বছর।
এই গাছের রাইজম খুঁজলে পেয়ে যাবেন। কিন্তু পুকুর বা ছয় ফুটের চৌবাচ্চা ছাড়া এই গাছে ফুল ফোটাতে পারবেননা । কতো মানুষ গামলায় বসিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে বসে থাকেন এর ফুল কবে ফুটবে বলে … কিন্তু ফোটে না।
ছবির পদ্মটা আমার সংগ্রহে থাকা Zhizhun Qianban বা Ultimate Thousand Petal (UTP) । বাড়িতে খুব কম থাকি বলে দেরীতে দেখেছি ফুলটা । এটা পঞ্চম দিনের ফুল। তাও কতো সুন্দর !
রিপট করলে আমার WhatsApp কমিউনিটিতে জানাবো। গুনে গুনে দশজনকে দেবো , সাথে গাইড ও করবো। ফুল পাবেন এই গ্যারান্টি থাকবে , ছোটো পটেই ফুল পাবেন। না পেলে পয়সা ফেরত ! যেমন গাইড করবো সেরকম করে যাবেন, ফুল পাবেন। তবে ধৈর্য ধরতে হবে।
© গাছপাকা।

গাছ নিয়ে এইরকম মূল্যবান টিপস সরাসরি আপনার হোয়াটস্যাপ একাউন্টে পেতে আমাদের "গাছের পাঠশালায়" ভর্তি হতে পারেন। এই পাঠশালায় রোজ গাছ নিয়ে ছোটো ছোটো টিপস শেয়ার করা হয়। খুব সহজে ,কম যত্নে আর কম খরচে গাছ করা সম্ভব ! ভালো গাছ করাটা কোনো রকেট সাইন্স না , কিন্তু সঠিক যত্নটা জানা দরকার আর চর্চায় থাকাটা দরকার।

আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ।

আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ “গাছপাকার গাছের পাঠশালা” ।রোজ একটু একটু করে গাছ করা শিখতে এই গ্রুপে জয়েন করুন।

আমাদের ফেসবুক পেজ।

আমাদের ফেসবুক পেজ “গাছপাকা” । গাছ নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই পেজটি ফলো করতে পারেন।

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ।

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ “গাছের সমস্যার সমাধান ” । আপনার গাছের সমস্যায় পরামর্শ চাইতে এই গ্রুপে পোস্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
× Whatsapp